গাজায় ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশি নারী শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করে তাকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় গ্রেপ্তার
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক অভিবাসন আইনজীবী মঈন চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই বাংলাদেশি ছাত্রী সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি নিরীহ শিশু ও নারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।
কিন্তু এরই জেরে মার্কিন কর্তৃপক্ষ তার F-1 স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
মঈন চৌধুরী আরও বলেন, “আমরা এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং তার মুক্তি নিশ্চিত করতে সব ধরনের আইনি সহায়তা দিচ্ছি। একজন শিক্ষার্থীকে শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের জন্য শাস্তি দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
পুরনো মামলায় নিষ্পত্তির পরও গ্রেপ্তার
এছাড়া, আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে দোকান থেকে ৭০ ডলারের পণ্য চুরির অভিযোগে পুরনো মামলায় দোষ স্বীকার করার পর আদালত থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE) তাকে গত সপ্তাহে পুনরায় গ্রেপ্তার করেছে।
মঈন চৌধুরী বলেন, “ছোটখাটো চুরির ওই মামলায় আদালত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সতর্ক করে দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করেছিল। কিন্তু ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই তাকে আটক করে এবং তার স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করে ডিটেনশনে পাঠায়। বর্তমানে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।”
বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা বাড়ছে
সাম্প্রতিক সময়ে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি (JFK) এয়ারপোর্ট থেকে ডজন খানেক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, কারণ তারা কাস্টমস কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।
ফেরত পাঠানোদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রিন কার্ডধারী ছিলেন, আবার কেউ ছিলেন ইমিগ্রান্ট ভিসাধারী বা পারিবারিক স্পন্সরের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে আগত অভিবাসী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির কঠোরতা দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু দেশের নাগরিকদের প্রতি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় যারা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন বা ছুটিতে গিয়ে দেশে ফিরে আসছেন, তাদেরকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ঢুকতে বলা হচ্ছে।
গ্রিন কার্ডধারীদের সতর্কতা
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন এর পরিচালক মঈন চৌধুরী বলেন, “গ্রিন কার্ডধারীরা যদি বছরে অধিকাংশ সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করেন, তাহলে তাদেরকে এয়ারপোর্টে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কেউ কেউকে মুচলেকা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে, আবার কারও কারও গ্রিন কার্ড জব্দ করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যারা দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন না, তাদের আগেই আইনি পরামর্শ নিয়ে আসা উচিত। অন্যথায় গ্রিন কার্ড বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
প্রবাসীদের পাশে করটেজ
এই সংকটকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন নিউইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-করটেজ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্রঙ্কসের কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট-১৪ এলাকার বাংলাদেশিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি অংশ নেন এবং বলেন, “আমার অফিস সবসময় প্রবাসীদের পাশে আছে। অভিবাসন ইস্যুতে তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য আমরা প্রস্তুত।”
এই মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন ব্রঙ্কস কমিউনিটি বোর্ডের অভিবাসন কমিটির চেয়ারম্যান শাহজাহান শেখ। তিনি করটেজকে জানান, “শুধু কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীরাই নয়, অনেক বৈধ গ্রিন কার্ডধারীও বর্তমানে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ ট্রাম্পের প্রশাসন ‘অভিযানের’ নামে যাকেই পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে।”
বৈধ হয়েও আতঙ্কে প্রবাসীরা
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি বৈধভাবে থাকার পরেও আতঙ্কে আছেন। কারণ, বর্তমান অভিবাসন পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে, ছোটখাটো ভুল বা পুরনো মামলার রেকর্ড থাকলেও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সরাসরি গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
পরামর্শ ও সতর্কতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছেন বা অভিবাসী ভিসায় প্রবেশ করছেন, তাদের অবশ্যই নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত:
সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখা
পাসপোর্ট, ভিসা এবং আগের ভ্রমণের রেকর্ড পর্যালোচনা করা
কোনো মামলা বা অভিযোগ থাকলে আগেই আইনি পরামর্শ নেওয়া
গ্রিন কার্ড থাকলেও নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতে প্রস্তুত থাকা
এই পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সতর্কতা, সচেতনতা এবং আইনি প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করা এবং যে কোনো জটিলতার ক্ষেত্রে প্রফেশনাল আইনি সহায়তা নেওয়া।